জাকসুতে ৩৩ বছর পর ভোট আজ

0
6
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভবনফাইল ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৩৩ বছর পর। আজ বৃহস্পতিবার এই নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ভোট দিতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।

ভোট গ্রহণ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। শিক্ষার্থীরাও ভোট দেওয়ার সুযোগ আসায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মোসাদ্দেকুর মমিন প্রথম আলোকে বলেন, বহু বছর পর জাকসুতে নির্বাচন হচ্ছে। শুরুতে কিছুটা কম থাকলেও ভোট নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এখন বেড়েছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দেবেন।

জাকসু ফিরে দেখা: ৫৩ বছরে নির্বাচন মাত্র ৯ বার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ৫৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি। তখন চারটি বিভাগে ২১ জন শিক্ষক ও ১৫০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে জাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই জাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগের প্রভাব বেশি ছিল। প্রথম নির্বাচনের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন গোলাম মোর্শেদ এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা শাহ বোরহানউদ্দিন রোকন। তখনকার দুজন শিক্ষার্থী জানান, গোলাম মোর্শেদ সরাসরি রাজনীতি না করলেও জাসদ ছাত্রলীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে পরপর তিন বছর জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরে আর ধারাবাহিকতা থাকেনি। সব মিলিয়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে নির্বাচন হয়েছে ৯ বার। তারপর আর হয়নি।

১৯৭৩ সালের জাকসু নির্বাচনটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, সেই নির্বাচনে ঢাকা থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে গিয়ে ব্যালট পেপার নিয়ে নেন। ভোটের হার হয়ে যায় ৯০ শতাংশের বেশি।

১৯৭৩ সালের জাকসুর জিএস মোজাম্মেল হককে আল-বেরুনী হলের নিজ কক্ষে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এর আগে জাকসুর প্রথম জিএস জাসদ ছাত্রলীগের শাহ বোরহানউদ্দিন ১৯৭২ সালে নারায়ণগঞ্জে খুন হন। তাঁরা দুজনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মূলত স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক কোন্দলে।

১৯৭৩ সালে জাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে জিএস প্রার্থী ছিলেন নুরুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোজাম্মেলকে গুলি করে হত্যার পর খুনিরা চলে যাওয়ার সময় সর্বহারা পার্টির নামে স্লোগান দিয়েছিল বলে সে সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন।

১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে জাকসু নির্বাচন হয়। ১৯৯২ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে ছাত্রদল একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করেছিল। তারা জাকসু ও হল সংসদের ১০৭টি পদের মধ্যে ১০৫টি পেয়েছিল।

জাকসুর সাবেক ভিপি (১৯৯০) আশরাফউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সময়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যতটুকু না কাজ করতে পেরেছি, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছি জাতীয় পর্যায়ে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জাকসু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’

১৯৯১ সালে আবার গণতন্ত্রে ফেরার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, সেই দলের ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করত এবং হল দখলে রাখত। পরাজয়ের ভয় ও হলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় ক্ষমতাসীনেরা ছাত্র সংসদে ভোট হতে দেননি। জাকসুতেও একই ঘটনা ঘটে।

অবশ্য জাকসুতে ১৯৯২ সালের পরের নির্বাচন বাতিল হয়েছিল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। তখনকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা জানা যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ ছিল। ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের জন্য নির্ধারিত শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন চলছিল। ওই নির্বাচন বানচালের জন্য শিক্ষকদের একটি গ্রুপ জাকসুর প্রতিনিধি ও ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। ওই হামলায় কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। পরে সভাপতি (উপাচার্য) জাকসু ভেঙে দেন।

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে গত মঙ্গলবার। সেখানে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টির মধ্যে ২৩টি পদে জয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির। আজ জাকসুর ভোট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট ২৫ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভোট অনুষ্ঠিত হবে ১২ অক্টোবর।

ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন

জাকসুতে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮ এবং ছাত্র ৬ হাজার ১৫ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে মোট ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। একই সঙ্গে ২১টি হল সংসদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।

সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রার্থী ৯ জন। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৮ জন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে ৬ জন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

একেকটি হলে পদসংখ্যা ১৫। ২১টি হল সংসদে মোট পদ ৩১৫টি। এতে ৪৭৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। ছাত্রীদের ১০টি আবাসিক হলে ১৫০টি পদের মধ্যে ৫৯টিতে কোনো প্রার্থী নেই। একজন করে প্রার্থী রয়েছে ৬৭টি পদে। সে হিসেবে মাত্র ২৪টি পদে ভোট হবে।

জাকসুতে মোট সাতটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে চারটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ও তিনটি আংশিক প্যানেল রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্যানেলগুলো হলো ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল, ছাত্রশিবির–সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম।

আংশিক প্যানেল দিয়েছে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন, স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ। এ ছাড়া অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন।

ধারণা করা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন ও ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেলের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশি হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেউ কেউ প্রতিযোগিতায় থাকতে পারেন।

জাকসু নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করা হয় গত ১০ আগস্ট। নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বেশির ভাগ প্রার্থী গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির (হলের অতিথিকক্ষে আদবকায়দা শেখানোর নামে নির্যাতন) বিলোপ, আবাসনসংকট সমাধান, নিরাপত্তা, পরিবহন সমস্যার সমাধান, খাবারের মান উন্নত করা, শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা, দলীয় প্রভাবের ছাত্ররাজনীতি থেকে মুক্ত রাখা ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সংশপ্তক পর্ষদের জিএস প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত দিনে ছাত্রলীগের গণরুম, গেস্টরুমের ব্যাপারে আমরা প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ছিলাম সাধারণ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর। জাকসুর মাধ্যমে সেসব অপসংস্কৃতি পুরোপুরি বিলোপ করাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য থাকবে।’

ভোটের প্রস্তুতি

নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে ১৩ হাজার ৩০০টি। ভোট গ্রহণের জন্য ২১টি কেন্দ্রে বুথ থাকবে ২২৪টি। ২১ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা, ৬৭ জন পোলিং কর্মকর্তা ও ৬৭ জন সহাকারী পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, বিভিন্ন প্রবেশপথ ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এক হাজারের বেশি পুলিশের সদস্য মোতায়ের রাখা হবে। প্রয়োজনে বাড়ানো হবে। পুলিশ সদস্যের অধিকাংশই ক্যাম্পাসের বাইরের দিকে অবস্থান করবেন। ভোটকেন্দ্রগুলোতে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।

কেন্দ্রের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় ৮০টি সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে এসব সিসি ক্যামেরা দিয়ে কেন্দ্রের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা হবে। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি পর্যবেক্ষণ দল, প্রক্টরিয়াল বডি এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পুরো ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করবেন। দুজন ম্যাজিস্ট্রেটও থাকবেন।

জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, একজন ভোটার কোনো কারণে ব্যালট পেপারে ভুল করলে তা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। তখন ওই ব্যালট পেপার বাতিল করে নতুন ব্যালট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ কারণে কিছু অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে।

সুষ্ঠু ভোটের আশা

জাকসুতে সম্প্রীতির ঐক্য চ্যানেলের ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায় জনের প্রার্থিতা বাতিল নিয়ে বিক্ষোভ ও উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনা ঘটেছে। নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকায় তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করেছিল নির্বাচন কমিশন। তিনি আদালতে গিয়েছিলেন। হাইকোর্ট প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত এ আদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। ফলে তাঁর আর নির্বাচন করা হচ্ছে না।

নির্বাচন নিয়ে এর বাইরে এখন পর্যন্ত প্রার্থীদের বড় কোনো অভিযোগ নেই। শিবির–সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিল, ক্যাম্পাসে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা থাকতে পারবেন না, সেটি নিশ্চিত করতে পারেনি। নির্বাচনের স্বচ্ছতার জন্য প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্ট রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। সেই অনুরোধ রাখেনি প্রশাসন। প্রার্থীদের মাদকাসক্তি পরীক্ষার (ডোপ টেস্ট) ফলাফলও প্রকাশ করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘এর পরও আশা করছি প্রশাসন একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেবে।’

সূএ : প্রথম আলো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here