ছেলের স্যান্ডেল বুকে চেপে মা বললেন, পানি খাইতে চাইসিল আমার ছেলেটা, ওরা দিল না

0
7
এই সেতুর ওপরই ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে যন্ত্রণা যেন আরও একবার উপলব্ধি করলেন রিহানের মা খাদিজা আকতার। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চন নগর গ্রামের তালুকদার বাড়ির কাছে একটি চায়ের দোকানের সামনে ভিড়। দোকানি মুহাম্মদ লোকমান আর তাঁর স্ত্রী খাদিজা আকতারকে ঘিরে আছেন উপস্থিত লোকজন। কাছে যেতেই শোনা গেল খাদিজার বিলাপের শব্দ। এক জোড়া স্যান্ডেল বুকে চেপে ধরে বলছিলেন, ‘আমার বুকের ধন, ছেলেটা শেষ মুহূর্তে একটু পানি চাইসিল। তা–ও দিতে দেয় নাই তারা। আমর সামনে পিটাই পিটাই ছেলেরে মারসে।’

‘চোর’ অপবাদ দিয়ে খাদিজা আকতারের ‘বুকের মানিক’ একমাত্র ছেলে মুহাম্মদ রিহানকে (১৫) গত শুক্রবার ভোরে তাঁর চোখের সামনেই পিটিয়ে মারা হয়। গ্রামেরই চেইঙ্গা সেতু এলাকায় আরও দুই কিশোরের সঙ্গে মব তৈরি করে তাদের পেটানো হয়। নিহত রিহান সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় আহত মুহাম্মদ রাহাত (১৫) ও মুহাম্মদ মানিক (১৪) প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনো শঙ্কা কাটেনি। গুরুতর আহত দুই কিশোর এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

রিহানের বাবা মুহাম্মদ লোকমান স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ক্যানটিন চালান। বাড়তি রোজগারের জন্য ছয় মাসে আগে বাড়ির পাশে চায়ের দোকান দেন। স্কুল ছুটি শেষে সেখানে সময় দিত রিহান, বেচাবিক্রিতে সহযোগিতা করত বাবাকে। সেই দোকানের সামনেই গতকাল শনিবার দুপুরে তাঁর মা–বাবাকে পাওয়া গেল। শোকে মুহ্যমান এই দম্পতির আহাজারি থামছিল না কোনোভাবেই।

খাদিজা বিলাপ করতে করতে রিহানের জন্মের কথা বলে যাচ্ছিলেন। ছেলে তাঁর অনেক সাধনার ধন। এর আগে পরপর তিন সন্তান মৃত ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এরপর ছেলেটি কোল আলো করে এল। রিহানের জন্ম তাই মায়ের কাছে বিশ্বজয়ের মতো ঘটনা। তিনি আদরের ধনকে কোরআনে হাফেজ বানাতে চেয়েছিলেন। বড় মানুষ করতে চেয়েছিলেন। সেসব কথা বলতে বলতে ‘ও রেহান রে , ও রেহান’ এমন আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল মা খাদিজার কণ্ঠ চিরে।

খাদিজা আকতারের বিলাপে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আশপাশের পরিবেশ। এমন নৃশংস ঘটনা ভুলতে হয়তো অনেক সময় লাগবে গ্রামের বাসিন্দাদের।

খাদিজা আকতারের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ছেলের আনা এক জোড়া চুড়ি। গত মঙ্গলবার রাতে বাজার থেকে মায়ের জন্য হাতের চুড়ি কিনে এনেছিল রিহান। খুশিতে চোখ ভিজে গিয়েছিল মায়ের। কে জানত, সেই চুড়িই হবে তাঁর সন্তানের শেষ উপহার? পরদিন বুধবার সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আরও দুই বন্ধু স্কুলছাত্র মুহাম্মদ রাহাত, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মুহাম্মদ মানিকসহ বেড়াতে গিয়েছিল কক্সবাজারে। দুই দিন সমুদ্রসৈকতে আনন্দ করে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে ফিরে আসছিল তারা তিন সমবয়সী বন্ধু। তাদের কল্পনাতেই আসেনি, এই ফেরাটা হবে মৃত্যুর দিকে যাত্রা।

শুক্রবার ভোর ৪টায় একটি অটোরিকশা নিয়ে বাড়ির সামনে রিহানের বাবার চা–দোকানের পাশে নামে তিন কিশোর। এ সময় হঠাৎ চোর চোর বলে তাদের ধাওয়া করেন লাঠিসোঁটা হাতে থাকা সাত থেকে আটজন। তাঁদের পিটুনি থেকে বাঁচতে রিহানরা দৌড়ে আশ্রয় নেয় নিজের বাড়ি থেকে ২০০ গজ দূরের নির্মাণাধীন একটি দোতলা বাড়ির ছাদে।

নিহত কিশোর মো. রিহান মাহিনছবি: স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত

পরে সেখান থেকে তাদের ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে নেওয়া হয় একটি সেতুর ওপর। সেখানে তিনজনকে বেঁধে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পেটানো হয় তিনজনকে। মারধরে মৃত্যু হয় রিহানের। শুক্রবার সন্ধ্যায় রিহানকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

রিহানের বাবা মুহাম্মদ লোকমান বলেন, ‘আসামিরা এখন বাঁচতে আমাদের টাকার অফার করছেন মামলা না করতে। ১০ লাখ লাগলে দেবে বলছে। কিন্তু আমি ছেলে বিক্রি করব না।’

কেন রিহানদের এভাবে পেটানো হলো, কেবলই চোর সন্দেহে? এলাকার কিছু লোক বলেন, ভিন্ন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ছিল বলেই কিশোরদের পেটানো হয়। খাদিজা আকতারও বিলাপের সুরে সে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘শুধু অন্য গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কেন করছে, সেই জন্য মারছে তাদের। শুধু সেই কারণে। আমি এখন কিছু চাই না। শুধু আসামিদের ফাঁসি চাই।’

এ ঘটনায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহত কিশোরের মা খাদিজা বেগম। মুহাম্মদ নোমান (২২) ও মুহাম্মদ আজাদ (২৩) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অন্য তিন আসামি হলেন নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ তৈয়ব ও মহিউদ্দিন। তাঁরা সবাই কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চন নগর গ্রামের বাসিন্দা।

পুলিশের ধারণা, পূর্বের বিরোধ থেকে চোর সন্দেহের নাটক সাজিয়ে ওই কিশোরদের পেটানো হয়েছে। আসামিদের বাড়ি রিহানদের বাড়ি থেকে ৩০০ মিটার দূরে। গতকাল দুপুরে আসামিদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, তাঁরা পরিবারসহ পালিয়ে গেছেন।

আর নিহত রিহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেড ঘরে রিহানের থাকার কক্ষে খাটে পড়ে আছে সপ্তম শ্রেণির বই ও তার বিদ্যালয়ের পোশাক।

পিটুনির ছবি তোলায় মারধর

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গ্রেপ্তার মুহাম্মদ আজাদের সঙ্গে ১৫ দিন আগে রিহানের চা–দোকানে তর্কাতর্কি হয়। সেই ক্ষোভ থেকেও ঘটনাটি ঘটতে পারে। তাঁরা বলেন, রিহান মারা যায় সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে। এলাকার শত শত মানুষ জড়ো হলেও কেউ কিছু করতে পারেননি। কারণ, আসামিরা পাশে ঘেঁষতে দেননি কাউকে। পাশাপাশি যাঁরা ফোনে ছবি বা ভিডিও করেছেন দূর থেকে, সেগুলো তাঁরা কেটে দিয়েছেন। কাউকে কাউকে ছবি তোলায় মারধরও করেছেন।

এদিকে পিটুনিতে আহত অন্য দুই কিশোর রাহাত ও মানিকের বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই দুজনের বাড়ি মাইজপাড়ায়। ছেলেদের চিকিৎসার জন্য দুজনের মা-বাবা চট্টগ্রাম নগরে অবস্থান করছিলেন।

মানিকের দাদি নসিমা খাতুন বলেন, তাঁর নাতি গ্রামের একটি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এ রকম ছাত্র কিশোরকে যাঁরা বেঁধে মারলেন, তাঁদের শাস্তি চান তিনি।

রাহাতের চাচা মুহাম্মদ আইয়ুব সওদাগর বলেন, তাঁর ভাতিজা স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ভাতিজারা তিন বন্ধু কক্সবাজার থেকে বাড়িতে এলে বিপথগামী যুবকদের হাতে নির্মম ঘটনার শিকার হয়। তিনি এ ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করেন।

মাইজপাড়ার বাসিন্দা ও রাহাতের চাচা তাজুল ইসলাম বলেন, মাইজপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মধ্যম কাঞ্চননগরের ছেলেদের বন্ধুত্ব কেন হবে, এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল দুটি পক্ষের। এর জের ধরে ছেলেগুলোকে বেঁধে মারা হলো।

গতকাল বেলা দুইটায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলামসহ পুলিশের একটি দল। পুলিশ সুপার নিহত রিহানের বাবাকে সান্ত্বনা দেন এবং হত্যাকারী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন।

সূত্রঃ প্রথম আলো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here