তুমি তেল যদি নাহি পাও, যাও তেলের সন্ধানে যাও…

রবিঠাকুর লিখেছিলেন, ‘…তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও…’। তবে এ কালে তিনি বাংলাদেশের বাজারে গেলে নিশ্চিতভাবেই ‘সুখ’ শব্দটির সমার্থক অন্য যুগোপযোগী শব্দ ব্যবহার করতেন। কারণ এ দেশে যে এখন তেলের অপর নামই জীবন!

পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত খবর বের হচ্ছে বাজারদর নিয়ে। শিরোনাম লিখতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না সংবাদকর্মীদের। নেই বিশ্লেষণের হ্যাপা। কারণ, দ্রব্যমূল্য শুধুই ঊর্ধ্বগামী। রকেট যদি কেবল ওপরের দিকেই ওঠে, তখন তো আর রকেট আদৌ বিধ্বস্ত হবে কি না, তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হয় না। ফলে সংবাদকর্মীরা এখন শুধুই দাম বাড়ার খবর দিয়ে যাচ্ছেন। শিরোনাম একদিন হচ্ছে ‘চাল ডাল তেল চিনি আটা ময়দার দাম বেড়েছে’, আরেকদিন হচ্ছে ‘সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়ানোর তোড়জোড়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। খবরের শুরুতেই লিখতে হচ্ছে, ‘স্বস্তি নেই বাজারে। দেশীয় উৎপাদিত কিংবা আমদানি করা কোনো পণ্য নিয়েই সুখবর নেই। এক সপ্তাহের ব্যবধানে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, আলু, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে মৌসুমি শাকসবজির দামও বেড়েছে।’

এমন অস্বস্তির এক বাজারে আমরা ম্যাংগো পিপলেরা হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেইন স্ট্রোক বা রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসে গলা ছেড়ে কাঁদার ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত যাচ্ছি। বিরোধীরা বলতেই পারেন, হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেইন স্ট্রোক হুট করে নানা কারণেই হতে পারে। কিন্তু রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসে কাঁদা তো নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ইচ্ছে করলেই এসব আবেগ মনের গহিনে বেঁধে রাখা যায়। কিন্তু পাঁচ বছর আগের সয়াবিন তেলের দামের কথা মনে পড়ে গেলে আসলেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ খুব খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এর ভুক্তভোগী। সম্প্রতি এক নিদারুণ পরিস্থিতিতে শুধু টিস্যুর অভাবে কাঁদতে পারিনি। না না, একদমই যে টিস্যু ছিল না, তা নয়। তবে যতটুকু ছিল, তা দিয়ে চোখ শুকানো কঠিন হতো। তাই বলছি, এমন পরিস্থিতিতে অশ্রু বিসর্জনে বাঁধ নির্মাণ বেশ কষ্টকর কাজ। বারবার ভেঙে যায় সেই বাঁধ!

আমার মতো আম আদমি যেখানে আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, সেখানে রবিঠাকুরের মতো সহমর্মী ও সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ নিশ্চয়ই চোখের জল ধরে রাখতে পারতেন না। সুতরাং, সুখের জায়গায় তেল বসেই যেতে পারত। হয়তো নতুন কিছু সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব ছিল না। হয়তো বিশ্বকবি মন খারাপ করে রাতের আঁধারে আবৃতি করতেন, ‘রয় যে কাঙাল শূন্য হাতে, দিনের শেষে, দেয় সে দেখা নিশিথরাতে স্বপনবেশে॥’

সে যাই হোক। কথা হলো, আমরা হাজারো অভাবে-অনটন বা সংকটেও সৃষ্টিশীল থাকি। এই যেমন বিয়েতে এখন উপহার হিসেবে সয়াবিন তেল দেওয়া হচ্ছে। আপাতত পাঁচ লিটার দিয়ে শুরু হয়েছে। তেলের দাম কমলে পরিমাণ আরও বাড়তেও পারে। আবার যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো এক লিটার তেলের বোতল পেলেই নবদম্পতি খুশিতে লাফিয়ে উঠবে! বলেও উঠতে পারে, ‘ওমা, তেল দিয়েছে! ওগো শুনছ, সামনের মাসটা কাটবে ভালোই।’

ওদিকে তেলে কড়া করে ভাজা পরোটা খাওয়ার অভ্যাস যাদের, তাদের দিনকাল খুবই বাজে যাচ্ছে। এমনই এক পরিচিতজন সেদিন বললেন, দোকানিকে নাকি বেশি তেলে ভাজতে বলেছিলেন পরোটা। আর তার জবাবে শুনতে হয়েছিল, ‘আমার শ্বশুর কি তেলের ব্যবসা করে? বেশি শখ থাকলে নিজে তেল কিইন্যা বাসায় ভাইজ্যা খান!’ এরপরের ঘটনা আরও নিদারুণ। কারণ, তিনি নিজে কিনতে গিয়ে দাম শুনে যেভাবে নিজেকে ‘লাঞ্ছিত’ বোধ করেছিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। শেষে এখন তেল ছাড়া পরোটা খাওয়ার অভ্যাস জারি রেখেছেন তিনি। সান্ত্বনা হিসেবে আছে, ‘আরে, বেশি তেল খাওয়া ভালো না। বলাই তো হয়, অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ।’

অনেক অনটনের গল্প হলো। এবার সম্ভাবনার দিকে তাকানো যাক। এই যে বাধ্য হয়ে সয়াবিন তেল কম খেতে হচ্ছে, এর ভালো দিকও আছে। শরীর-স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই তাতে আশঙ্কামুক্ত থাকবে। এভাবে যদি তেল খাওয়া একেবারে কমিয়ে দেওয়া যায়, তবে হয়তো একদিন একটি ‘মেদহীন’ জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব! আহা, ভাবতেই বুকটা আনন্দে ধুকপুক করছে।

কিন্তু খবরদার। তেল যতই কম খান, তেল দিতে কখনো কার্পণ্য করবেন না যেন। তাহলে কিন্তু এ দেশে আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়ানো হবে না। সুতরাং, আমাদের মূলমন্ত্র হোক—‘তেল খাওয়া কমান, তেল দেওয়া বাড়ান!’ কেবল তখনই একটি তেল চকচকে জীবন আপনার পায়ে হুটোপুটি খাবে।

তবে তাই হোক। শরীরের ভেতরে যেতে না পারলেও, তেল আপনার সারা গায়ে লেপ্টে থাকুক। এই অ/শুভ কামনায় শেষ করছি আজকের অধিবেশন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here